আমাদের প্রত্যেকের মানসিকতা আলাদা আলাদা। কেউ কেউ খুব দায়িত্বশীল , আবার কেউবা কাজে ফাঁকি দিতে ওস্তাদ। কেউ কেউ অপরকে সাহায্য করতে চাই , কেউবা এড়িয়ে যেতে চাই। আসুন, ১০০ বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা থেকে বিচার করা যাক আমাদের মানসিকতা কি হওয়া উচিত ………
মানসিকতাঃ
টাইটানিকের গল্পঃ
১৯১২ সালের ১০ই এপ্রিল, বিশ্বের বৃহত্তম বিলাসবহুল যাত্রীবাহী জাহাজ টাইটানিক ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন থেকে আনুমানিক ২২২৪ জন যাত্রী নিয়ে নিউইয়র্ক সিটির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল। এটি ছিল তার প্রথম যাত্রা । এই জাহাজের Captain ছিলেন মিঃ এডওয়ার্ড জন স্মিথ। জাহাজ খুব ভালোই চলছিল । যাত্রার চতুর্থ দিনে অর্থাৎ ১৪ ই এপ্রিল উত্তর আতলান্তিক মহাসাগরের উপর দিয়ে যাবার সময় জাহাজের বেতার চালক জ্যাক ফিলিপ্স দুপুর ১ টা ৪৫ মিনিট নাগাদ আমেরিকা নামক এক জাহাজ থেকে এক সতর্কবার্তা পান যে, টাইটানিকের যাত্রাপথে এক বড় হিমশৈল আছে। কিন্তু তিনি এটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে জাহাজের মূল নিয়ন্ত্রন কেন্দ্রে এই তথ্য প্রেরন করলেন না । জাহাজ চলতে লাগল । এরপর S S Californian নামক জাহাজ থেকে আরও ছয় বার একই সতর্কবার্তা পাঠানো হয়, কিন্তু টাইটানিকের বেতার চালক কোন কথাতেই কর্ণপাত করলেন না। টাইটানিকের চালক যখন হিমশৈল দেখতে পেলেন তখন জাহাজ তার সর্বোচ্চ গতিতে ছিল । তিনি চেষ্টা করেও জাহাজ নিয়ন্ত্রন করতে পারলেন না। জাহাজ হিমশৈলে ধাক্কা খেল । জাহাজের ৯০ মিটার অংশ জুড়ে ফাটল দেখা দিল এবং তা দিয়ে হু হু করে জল ঢুকতে লাগল । ইঞ্জিনিয়াররা হাজার চেষ্টা করেও জল বের করতে পারলেন না। শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি , বেতার চালক জ্যাক ফিলিপ্স এর দায়িত্বজ্ঞানহীন মানসিকতা ২২২৪ জন যাত্রীর জীবনে বিপদ ডেকে আনল ।
শুরু হল যাত্রীদের বাঁচানোর লড়াই । জাহাজে ২০ টি লাইফ বোর্ড ছিল। সবগুলো জলে নামানো হল। বিভিন্ন দিকে জরুরী বিপদসঙ্কেত পাঠানো হল । প্রথম যে জাহাজটি টাইটানিকের বেতার সঙ্কেত পেল তার নাম Carpathia। জাহাজটি তখন টাইটানিক থেকে ৫৮ মাইল দূরে অবস্থান করছিল । Carpathia র Captain মিঃ আর্থার হেনরি রোস্টন হিসেব করে দেখলেন যে, সর্বোচ্চ গতিবেগে গেলেও টাইটানিকের কাছে পৌছতে তাঁর চার ঘণ্টা সময় লাগবে । তবু তিনি নির্দেশ দিলেন টাইটানিকের কাছে যাবার জন্য । ভোর চারটে নাগাদ যখন তিনি অকুস্থলে পৌঁছালেন , দেখলেন , টাইটানিকের চিহ্নমাত্র নেই, লাইফ বোর্ডগুলো ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । মাইনাস দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সকলেই মৃতপ্রায় । এমতাবস্থায় তাঁরা প্রায় ৭০৬ জন মহিলা ও শিশুকে উদ্ধার করলেন । এইভাবে Carpathia জাহাজের Captain এর মানসিকতা ৭০৬ জন যাত্রীর প্রাণ রক্ষা করল ।
টাইটানিকের সবচেয়ে কাছে , মাত্র ১৯ মাইল দূরে ছিল S S Californian জাহাজ । সেই জাহাজের বেতার চালক মিঃ সিরিল ফার্মস্টোন ইভান্স আগে ৬ বার টাইটানিকের বেতার চালককে বিপদ সঙ্কেত পাঠিয়েছিলেন , কিন্তু সেখান থেকে কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে তিনি ওয়্যারলেস বন্ধ করে ঘুমাতে চলে গিয়েছিলেন । তাই টাইটানিকের পাঠানো বেতার সঙ্কেত তিনি বুঝতে পারেন নি। বেতার যোগাযোগে কোন সাড়া না পেয়ে মোর্স ল্যাম্প ও রকেট ছোঁড়ার মাধ্যমেও Californian এর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন টাইটানিকের Captain । Californian জাহাজের শিক্ষানবিশ মিঃ জেমস গিবসন রকেটের সঙ্কেত দেখে Californian এর Captain কে জানালে, Captain মিঃ স্টেনলি লর্ড বলেন, আজ রাত কিছু করার দরকার নেই, কাল সকালে দেখা যাবে। তিনি যদি সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার করতে যেতেন তবে মাত্র দেড় ঘণ্টা সময় লাগতো টাইটানিকের কাছে পৌঁছাতে, যেখানে টাইটানিক ডুবতে সময় নিয়েছিল ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। অর্থাৎ সমস্ত যাত্রীদের বাঁচানো সম্ভব হতো । এইখানে Californian জাহাজের Captain এর মানসিকতার জন্য প্রায় ১৫১৭ জন মানুষের মৃত্যু ঘটলো ।
বিশ্লেষণঃ
কাজেই দেখা যাচ্ছে , একজনের একরকম মানসিকতার জন্য টাইটানিকের মতো জাহাজ ডুবে গেল । অপর একজন লোকের ঠিক একই মানসিকতার কারণে ১৫১৭ জনকে বাঁচানো গেল না। অন্যদিকে , অপর একজনের ভিন্ন মানসিকতার কারণে ৭০৬ জনের প্রাণ রক্ষা পেলো ।
শিক্ষাঃ
আমাদের মানসিকতা উচ্চ হতে হবে। আমাদের দায়িত্ববান হতে হবে। কোন কিছুকেই ছোট করে দেখা ঠিক নয়, সবকিছু গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা উচিত ।